জানা যায়, রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে বাজার ষ্টেশনে জড়ো হয়। প্রথমেই মিছিলকারীরা জেলা প্রশাসক ও কোর্ট চত্ত্বর এলাকার কয়েকটি স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে। সেখানে অবস্থিত নির্বাচন অফিস, পুলিশ সুপারের ক্যান্টিন ও ডিসি গার্ডেনের ভাংচুরসহ ত্রান দুর্যোগ গোডাইন ভাংচুর করে মালামাল লুটপাট করে নেয়। এরপর বাজার স্টেশনের পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। পর্যায়ক্রমে ছাত্র-জনতা মুল শহরে প্রবেশ করে মুজিব সড়কে সংসদ সদস্য ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরীর বাসভবন, এস.এস রোডে সাবেক এমপি ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না, সংসদ সদস্য চয়ন ইসলাম এবং জেলা শহরের মুজিব সড়কে স্থানীয় দৈনিক যুগের কথা পত্রিকা অফিসে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ আওয়ামীলীগ অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টার, ভুমি অফিস, কোর্ট চত্ত্বরের কয়েকটি স্থাপনায় আগুন দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে রবিবার সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর বাসভবন আগুনে পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এঘটনায় তার বাসা থেকে রোববার (৪ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে দুজনের কঙ্কাল উদ্ধার হয়। এদের মধ্যে একজন শহরের জানপুর এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী শাহিন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্য জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
নিহতরা হলো-সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের মাসুমপুরের মাজেদ খানের ছেলে যুবদল নেতা মুঞ্জু (৩৫), শহরের গয়লা বটতলা এলাকার গঞ্জের আলী ছেলে ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র সুমন (২৪), গয়লা ভোকেশনাল রোড এলাকার আছের আলীর ছেলে যুবদল কর্মী আব্দুল লতিফ (৩৫) ও রায়গঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ছরোয়ার লিটন (৫০), উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক আলামিন সরকার (৪০), ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম (৪০), ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম হাসনাইন টিটু ও দৈনিক খবরপত্র পত্রিকার সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক (৬০)।
পুলিশের নিহতরা হলেন-চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের মহারাজপুর গ্রামের মাহতাব মন্ডলের ছেলে ও এনায়েতপুর থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক, পাবনার সুজানগর উপজেলার ভাদরভাগ গ্রামের শাহাদৎ হোসেন খানের ছেলে এসআই রইজ উদ্দিন খান, একই উপজেলার মানিকহাট গ্রামের প্রশান্ত কুমার বিশ্বাসের ছেলে এসআই প্রনবেশ কুমার বিশ্বাস, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার জলঢাকা বাজার এলাকার খলিরুর রহমান মন্ডলের ছেলে এসআই মো. তহছেনুজ্জামান, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দেবকুন্ডা গ্রামের মনছুর আলী মোল্লার ছেলে আনিছুর রহমান মোল্লা, নওগা সদরের কোমায়গাড়ি গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে এএসআই ওবায়দুর রহমান, পাবনা সুজানগর উপজেলার খয়রান গ্রামের সেকেন্দার আলী মল্লিকের ছেলে কনস্টেবল আরিফুল আযম, একই উপজেলার খাপুর গ্রামের আবু জাফরের ছেলে কনস্টেবল রিয়াজুল ইসলাম, নওগার পত্নীতলা উপজেলার আমন্তপুর গ্রামের তোজাম্মেল হক শাহের ছেলে কনস্টেবল রবিউল আলম, পাবনার সাথিয়া উপজেলার হাঁড়িয়া গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে কনস্টেবল হাফিজুল ইসলাম, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার আগপুংগলী গ্রামের আল আমিন মোল্লার ছেলে কনস্টেবল আব্দুস সালেক, রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের লোকমান আলীর ছেলে কনস্টেবল লোকমান আলী ও একই উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে কনস্টেবল শাহিন উদ্দিন। ঢাকায় রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত দুজনের মধ্যে এসআই নাজমুলের নাম জানা গেলেও অপর কনষ্টেবলের নাম পরিচয় বিস্তারিত জানা যায়নি।
এ সময় জেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে আগুন দিতে গেলে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মঞ্জু, সুমন ও আব্দুল লতিফ মারা যায়। অন্যদিকে, রায়গঞ্জে ছাত্র-জনতা আওয়ামীলীগে অফিসে হামলা চালায়। এ সময় আওয়ামীলীগ অফিসের ভিতরে থাকা ৩ জন আওয়ামীলীগ নেতা ও সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করে। এছাড়াও হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানা ও এনায়েতপুর থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। উল্লাপাড়া আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে আগুন ও ভাংচুর, কেন্দ্রীয় যুবলীগের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথির বাড়ীতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন ভাংচুর, উল্লাপাড়া পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম ও উল্লাপাড়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকমল হোসেনের বাড়ী ও তেলের মিল ভাংচুর করা হয়েছে। শাহজাদপুর সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের বসতবাড়ী ভাংচুর ও গাড়ীসহ বসতবাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পৌরসভার দুটি গাড়ী ভাংচুর, আওয়ামীলীগ কার্যালয় ভাংচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা মোস্তফাজ্জামান বিএনপির কর্মী শহরের মঞ্জু, সুমন ও আব্দুল লতিফের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে রায়গঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আমিমুম ইহসান তৌহিদ জানান, মৃত অবস্থায় গোলম সারোয়ার লিটন, আল আমীন হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেনের মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক ও গোলাম হাসনাইন টিটু আহত অবস্থায় আসলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
বিভাগীয় অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) বিজয় বসাক জানান, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় ১৩জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। তবে তিনি নাম পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি।
বুধবার (৭ আগষ্ট) সকালে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আনিসুর রহমান, এনায়েতপুর থানায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত থানার আরো অনেক পুলিশ সদস্যের খোঁজ পাওয়া যায়নি। উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইনে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিহত ১৩ জনের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিহতদের মধ্যে একজন ওসি, পাঁচজন এসআই, একজন এএসআই ও আটজন কনস্টেবল রয়েছেন।